কালো টাকা কি | What is Black Money in Bengali
সুপ্রিয় বন্ধুরা,
বিশ্ব অর্থনীতিতে নানা দেশে ভিন্ন ভিন্ন রঙের টাকা আছে, তেমনি একই নোটে আছে অনেক রঙের ব্যবহার। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোথাও কালো রঙের টাকার প্রচলন হয়নি, তবুও বিশ্বজুড়ে ‘কালো টাকা’ এই শব্দযুগলের ব্যাপক ভাবে প্রচলন রয়েছে।
কিন্তু কি এই কালো টাকা এই সম্পর্কে অনেকেই ঠিকমতো জানেন না, আর তাই আজকের পোস্টে কালো টাকা কি বা কালো টাকা কাকে বলে এবং কালো টাকার ক্ষতিকর প্রভাবগুলি নিয়ে আলোচনা করলাম।
আমরা আশা রাখবো, আমাদের এই আর্টিকেলটি আপনাদের কালো টাকা সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা গঠন করতে ভীষণভাবে সাহায্য করবে। আর হ্যাঁ প্রথমেই বলে দিই এই কালো টাকা কিন্তু কোনো কালো রঙের টাকা নয়।
কালো টাকা কি ?
অর্থনীতিতে কালো টাকা সর্বত্র বিরাজমান, এই কালো টাকার অর্থনীতিতে দেশ ছাড়াও কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত দেশগুলোতে বিদ্যমান, হতে পারে তারা উন্নত বা উন্নয়নশীল। কিন্তু কালো টাকার কর্মকান্ডে সবাই জড়িত। অলিপিবদ্ধ অর্থনীতিতে কালো টাকা বলতে সেইসব অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে বোঝায় যা প্রতিষ্ঠিত আর্থিক নিয়মনীতি নিরিখে অবৈধ লেনদেন থেকে প্রাপ্ত আয়, যার ওপর ভিত্তি করে আয়কর ও অন্যান্য কর পরিশোধ করা হয়নি বা আংশিক পরিশোধ হয়েছে, যা শুধুমাত্র কিছু প্রকারের অর্থ পাচারের মাধ্যমে বৈধ করা যায়।
অন্যভাবে বলতে গেলে, যে সব অলিপিবদ্ধ আয়-সম্পত্তির পরিমাণ জাতীয় হিসাবরক্ষণ পদ্ধতির মধ্যে নথিভুক্ত করা উচিত কিন্তু করা হয়নি, সেই সব আয়-সম্পত্তি কালো টাকার অন্তর্গত। তবে অর্থনীতিতে অপর্যক্ষিত কালো টাকার আকার এবং ব্যাপ্তি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
তবে সাধারণভাবে কালো টাকা বলতে এমন টাকাকে বোঝানো হয়, যার উৎস বৈধ বা আইনসম্মত নয়। ঘুষ, দুর্নীতি, কালোবাজারি, চোরাকারবার, মাদক ও অস্ত্রসহ নিষিদ্ধ পণ্যের ব্যবসা থেকে উপার্জিত অর্থ হচ্ছে কালো টাকা। তবে আয়কর আইন অনুসারে বৈধ উৎস থেকে অর্জিত অর্থও কালো হতে পারে, যদি টাকার মালিক তার আয়কর বিবরণীতে তার উল্লেখ্য টাকা করযোগ্য হলেও কর না দেন। অবশ্য আয়কর আইনে কোথাও কালো টাকার উল্লেখ না থাকলেও সেখানে অপ্রদর্শিত অর্থের উল্লেখ আছে। সেখানে উল্লেখ আছে আয়ের যে অংশ আয়কর বিবরণীতে প্রদর্শন করা হয় না, তা-ই অপ্রদর্শিত অর্থ। সাধারণভাবে যা কালো টাকা নামে পরিচিত।
তবে কেউ কেউ কালো টাকা ও অপ্রদর্শিত অর্থের মধ্যে একটা স্পষ্ট সীমারেখা টানার পক্ষে। তাদের মতে, অপ্রদর্শিত অর্থের উৎস বৈধ হতে পারে, আবার অবৈধও হতে পারে। কিন্ত কালো টাকার উৎস নিশ্চিতভাবেই অবৈধ। তাই বৈধ অপ্রদর্শিত অর্থের সঙ্গে কালো টাকাকে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়। তাদের মতে, নানা কারণে বৈধ অর্থও অপ্রদর্শিত থেকে যেতে পারে, এটি যেমন ইচ্ছাকৃত হতে পারে, তেমনই আইনি জটিলতার কারণেও হতে পারে। ধরা যাক, একজন ব্যবসায়ী কর ফাঁকি দেওয়ার অসাধু উদ্দেশ্য থেকে তার বার্ষিক আয়ের একটা অংশ চেপে গেছেন, আয়কর বিবরণীতে উল্লেখ করেন নি। এক্ষেত্রে উল্লেখ না করা ওই অর্থ বাস্তবে অপ্রদর্শিত অর্থ -এটা ইচ্ছাকৃত।
আবার একজন ব্যাক্তি হয়তো উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অথবা আগে কিনে রাখা এক খন্ড জমি বিক্রি করেছেন। কিন্তু আইনী জটিলতায় পুরো অর্থ আয়কর বিবরণীতে দেখাতে পারেন নি। কারণ ভূমি অধিদপ্তর বিভিন্ন এলাকায় জমির একটি দর নির্ধারণ করে দিয়ে থাকে। তাই চাইলেও জমি বিক্রির দলিলে তার বেশি মূল্য উল্লেখ করা যায় না। তাই প্রকৃত বিক্রয় মূল্যের চেয়ে কম মূল্য উল্লেখ করতে হয়। এমন পরিস্থিতি বিক্রয় মূল্যের বাকী অংশ আয়কর বিবরণীতে উল্লেখ করা যায় না। এভাবেও বৈধ পথে উপার্জিত টাকা অপ্রদর্শিত থেকে যায়। যেটাও কালো টাকার অন্তর্গত।
আবার দেখা যায় যে, কোনো ব্যক্তি স্বর্ণালঙ্কার বা রত্ন জাতীয় কোনো পণ্য ক্রয় করলেন। কিন্তু তার বৈধ্য কাগজ বা চালান কাটলেন না এক্ষেত্রেও তা কালো টাকার অন্তর্গত হয়।
ভারতের বৈদেশিক কালো টাকার তথ্য
বিশ্বজুড়ে ‘কালো টাকা’ এই শব্দযুগলের ব্যাপক ভাবে প্রচলন রয়েছে, ভারতবর্ষ তার ব্যাতিক্রমী নয়। দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে ভারতবর্ষের অর্থনীতির ইতিহাসে কালো টাকা এক রহস্যময় অধ্যায়। প্রাচীন ইতিহাস শুরু করে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাস ঘটলেও দেখা যায় যে, ভারতবর্ষ ছিল তৎকালীন সময় বহুরত্ন -ধনসম্পদে মোড়া দেশ। যার ফলে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দেখা দিল একশ্রেণীর মানুষের কাছে কালোধন গচ্ছিত করার মানসিকতা ও প্রতিপত্তি। স্বাববিক ভাবেই এ দেশে কালো টাকার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা অনেকাংশে বেশী হয়।
ভারতে, কালো বাজারে অর্জিত আয়কে কালো টাকা বলা হয়ে থাকে, যার উপর কোনো আয়কর ও অন্যান্য কর পরিশোধ করা হয় না। ভারতে কালো টাকার বাজার পরিস্থিতি মহামারী আকার ধারণ করেছে। ভারত বর্তমানে অবৈধ অর্থের জন্য সমগ্র বিশ্বের মধ্যে শীর্ষে, হিসেব করা হয় অপ্রদরশিত আয় হিসেবে $ ১,৪৫৬ বিলিয়ন ডলার সুইস ব্যাংকে জমা রাখা আছে। সুইস ব্যাংকিং অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, সম্মিলিত বাকি বিশ্বের চেয়ে ভারতের বেশি কালো টাকা রয়েছে। ভারতীয় সুইস ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সম্পদ মূল্য তার দেশের জাতীয় ঋণের ১৩ গুন (১৩০০%) এবং যদি এই কালো টাকা উদ্ধার করা এবং দেশে ফিরে আনা হয় সম্ভব হয় তা হলে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দশে পরিণীত হবার সম্ভাবনা আছে। তবে ভারতীদের বিরুদ্ধে সুইস ব্যাংকে ট্রিলিয়ন ডলার কালো টাকা গচ্ছিত রাখার অভিযোগ বিতর্কিত। সুইস ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন ও সুইজারল্যান্ড সরকারের পরবর্তী রিপোর্টে দাবী করে যে, এই অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট, আর ভারতীয়দের দ্বারা সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার পরিমান $২ বিলিয়ন ডলার।
কালো টাকার ক্ষতিকর প্রভাব
বিভিন্ন অবৈধ উপায় কালো টাকার উৎস হলেও এ অর্থ নিজেই একটি বড় সংকট। কারণ মানুষের হাতে অনেক বেশি কালো টাকা থাকলে তাতে দুর্নীতি বাড়ে। অপরাধ জগতে এসব অর্থ বেশি ব্যবহৃত হয়। কালোবাজার ও অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে ঘুষ লেনদেনে অতিরিক্ত মাত্রা পায়। নিম্নলিখিত কারণগুলি দেখলে ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে, যথা-
- চোরাচালান
দেশে কালো টাকার পরিমান যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেলে, কালো টাকার বৃত্তিশালী ব্যক্তিরা চোরাচালান যুক্ত কাজের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। প্রসঙ্গত গরুপাচার, মাদকপাচার বিষয় গুলি উল্লেখ করা যেতে পারে।
- মুদ্রাস্ফীতি
এক শ্রেণীর মানুষের কাছে অবৈধ অর্থের পরিমান বৃদ্ধি পেলে কালপরিধিতে মুদ্রাস্ফীতির মতো বিষয়গুলি বিশালাকার ধারণ করে।
- জাতির নূন্যতম আয় হ্রাস
দেশে কালো টাকার পরিমান যথেচ্ছ বৃদ্ধি পেলে জাতি তথা দেশের আয়ের পরিমান হ্রাস পায়। ফলে দেশের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হয়।
- অপরাধমূলক কাজকর্ম বৃদ্ধি
কালো টাকার সঙ্গে অপরাধমূলক কাজকর্ম সরল সম্পর্ক। অর্থাৎ যেখানে কালো টাকার পরিমান বৃদ্ধি পাবে সেখানে অপরাধমূলক কাজকর্মের সংখ্যা ততই বৃদ্ধি পাবে।
■ আরো পড়ুনঃ ইডির গঠন, কার্যাবলী, দপ্তর, নিয়োগ পদ্ধতি