সমাজ সংস্কারক হিসাবে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান
সুপ্রিয় বন্ধুরা,
বাংলা তথা ভারতের গর্ব রামমোহন রায়, যিনি আমাদের সকলের কাছে রাজা রামমোহন রায় নামে এবং ভারত পথিক নামে পরিচিত ছিলেন। আর আজকের পোস্টে সমাজ সংস্কারক হিসাবে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করলাম। যেটির মধ্যে খুব সুন্দরভাবে সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা বা অবদান সম্পর্কে আলোচনা করা আছে।
সমাজ সংস্কারক হিসাবে রাজা রামমোহন রায়ের অবদানঃ
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে যে সকল সমাজ সংস্কারকের আবির্ভাব ঘটে, তাদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় ছিলেন ভারতীয় নবজাগরণের অন্যতম চিন্তা নায়ক। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সমন্বয় সাধন ঘটাতে চেয়ে ছিলেন। ভারতবর্ষে আধুনিক শিক্ষার সম্প্রসারণের পাশাপাশি সমাজ সংস্কারক হিসাবেও তার অবদান ছিল অপরিসীম।
সমাজ সংস্কারক হিসাবে তিনি যে সকল ভূমিকা পালন করেছিলেন, সে সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল –
০১) সতীদাহ প্রথার বিলোপ সাধনঃ
সমাজ সংস্কারক হিসাবে রাজা রামমোহন রায়ের প্রথম পদক্ষেপ ছিল তৎকালীন হিন্দুসমাজের অন্যতম গুরুতর ও ভয়ংকর সমস্যা সতীদাহ অবসান ঘটানো। তিনি মনে করতেন, সতীদাহ প্রথা হল সভ্যতা বিরোধী, নিরীহ নারী বিরোধী ও মানব বিরোধী এক সংঘটিত অপরাধ। এই প্রথায় মূলত সম্পত্তির জন্য সমাজের বয়স্ক পুরুষেরা নারীদের ওপর বর্বর হিংস পশুর মত হত্যা করত। সমাজ স্বাধীন চেতা রাজা রামমোহন রায় এই বর্বর ও ঘৃন্য প্রথার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আন্দোলন শুরু করেন। রাজা রামমোহন রায় সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন নারীরাও মানুষ, তাঁদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। শেষ পর্যন্ত তাঁর আন্দোলনের চাপে ১৮২৯ সালে তৎকালীন বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এই অমানবিক প্রথাকে আইন করে বন্ধ করে দেন।
০২) সম্পত্তিতে ছেলে-মেয়েদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠাঃ
তৎকালীন ভারতীয় সমাজে নানা কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলে নারীদেরকে এক বিশেষ মর্যাদা দানে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাহার কাছে মেয়েরা যেন সম্পত্তির ক্ষেত্রে পুরুষদের মত সমানাধিকার পায়, তা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। তৎকালীন সমাজে মেয়েদেরকে মানুষ বলেই গণ্য হত না। পিতার সম্পত্তি বা পারিবারিক সম্পত্তির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র পুত্র সন্তানরাই অধিকার ভোগ করত। ফলে কন্যা সন্তানরা শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, বরং সামাজিক দিক থেকেও বঞ্চিত হত। এই বৈষম্যমূলক রীতির বিরুদ্ধে রাজা রামমোহন রায় প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন এবং নারীদের সম্পত্তির অধিকারের দাবীতে আইন প্রণয়নের জন্য আন্দোলন শুরু করেন যে পরবর্তী কালে এই ব্যাপারে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করেছিল।
০৩) বাল্য ও বহুবিবাহ প্রথার বিলোপ সাধনঃ
রাজা রামমোহন রায় শুধুমাত্র সতীদাহ প্রথা রোধ বা সমাজে মেয়েদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার পরও ক্ষান্ত হননি। তিনি তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের ভয়ংকর কতকগুলি প্রথা যেমন বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের প্রথার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তিনি কুলীন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহ অধিকারের বিরুদ্ধে এবং শিশুকন্যাদেরকে কুলীন বৃদ্ধদের সঙ্গে বিয়ে দেবার প্রথার বিরুদ্ধে নানাভাবে জনমত গড়ে তোলেন।
০৪) নারী শিক্ষার সম্প্রসারনঃ
রাজা রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কারের আরও একটি বিশেষ দিক হল নারী শিক্ষার সম্প্রসারণ। তিনি নারী শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে নারীমুক্তি আন্দোলনকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে সমাজে শিক্ষিত নারী সমাজের অগ্রগতি না হলে সমগ্র জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
০৫) ভারতীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সংরক্ষণঃ
ভারতীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ব্যাপারেও রাজা রামমোহন রায়ের অবদান কম নয়। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে কৃষ্টি ও সংস্কৃতির উপরই দাঁড়িয়েই এদেশের উন্নয়ন সাধিত হবে। সুতরাং ভারতীয় কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ঐক্যবোধের সংরক্ষন করা একান্ত প্রয়োজন। ফলতু পাচ্য ও পাশ্চাত্য মেলবন্ধন করা সম্ভব হবে।
০৬) ভারতীয়দের স্বার্থ রক্ষাঃ
তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন- চাকুরী, আইন ব্যবস্থা, শাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারতীয়দের তেমন কোন গুরুত্ব দেওয়া হত না। কিন্তু রাজা রামমোহন রায় এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ভারতীয় নাগরিকদের স্বার্থে নানা প্রস্তাবসমূহ বিট্রিশ পার্লামেন্টের কাছে তুলে ধরেছিলেন। যেমন- বিশেষ করে চাকুরীতে ভারতীয়দের নিযুক্তিকরন, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনগুলিকে বিধিবদ্ধ করা ইত্যাদি।
সুতরাং, উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে, আধুনিক ভারতের সমাজ সংস্কারক হিসাবে রাজা রামমোহন রায় এক উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। এসব কারণেই তাঁকে ‘আধুনিক ভারতের অগ্রদূত’ বা ‘ভারত পথিক’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
■ Also Check : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাদর্শন