Wednesday, October 30, 2024
Homeগান্ধীজিগান্ধীজির বুনিয়াদী শিক্ষা পরিকল্পনা | Gandhiji's Basic Education

গান্ধীজির বুনিয়াদী শিক্ষা পরিকল্পনা | Gandhiji’s Basic Education

গান্ধীজির বুনিয়াদী শিক্ষা পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করো।

গান্ধীজির বুনিয়াদী শিক্ষা পরিকল্পনা | বুনিয়াদি বা নঈ তালিম শিক্ষা

গান্ধীজির বুনিয়াদী শিক্ষা পরিকল্পনা | Gandhiji's Basic Education
গান্ধীজির বুনিয়াদী শিক্ষা পরিকল্পনা

সুপ্রিয় বন্ধুরা,
আজকের পোস্টে গান্ধীজির বুনিয়াদী শিক্ষা পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। যেটিতে বুনিয়াদী শিক্ষা পরিকল্পনা কি, বুনিয়াদী শিক্ষার বৈশিষ্ট্য, বুনিয়াদী শিক্ষার গুণাবলী, বুনিয়াদী শিক্ষার সীমাবদ্ধতা প্রভৃতি সমস্ত কিছু খুব সুন্দরভাবে আলোচনা করা আছে।

মহাত্মা গান্ধী ও বুনিয়াদি শিক্ষা ব্যবস্থা

ভারতে আধুনিক শিক্ষার বিকাশ মূলত পাশ্চাত‍্য শিক্ষা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে ঘটলেও ভারতীয় শিক্ষাবিদদের মধ্যে যার শিক্ষাচিন্তা পরাধীন ভারতবর্ষে আপামর জনগণকে নতুন পথের সন্ধান দেয় এবং শিক্ষার্থীদের সাবলম্বী করে জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে পথ প্রর্দশকের ভূমিকা পালন করেন তিনি হলেন স্বাধীন ভারতের রূপকার তথা জাতির জনক মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী। তিনিই হলেন টলস্টয়ের গড়ে তোলা শিক্ষা পরিকল্পনার রূপকার, তার এই পরিকল্পিত ও প্রবর্তিত পরিকল্পনাকে ভারতবর্ষে আমরা বুনিয়াদী শিক্ষা পরিকল্পনা বলে জানি।

গান্ধীজির শিক্ষাচিন্তার সার্থক রূপায়ন হল শিল্পকেন্দ্রিক বুনিয়াদী শিক্ষা পরিকল্পনা। ১৯৩৭ সালে গান্ধীজি ‘হরিজন পত্রিকায়’ তাঁর বুনিয়াদী শিক্ষার পরিকল্পনাটি প্রথম প্রকাশ করেন। ১৯৪৫ সালে সেবাগ্রামে বুনিয়াদী শিক্ষার এক সম্মেলন হয়। এখানে বুনিয়াদী শিক্ষাকে শিক্ষাক্ষেত্রে বিল্পব বলে আখ্যা হয়। বুনিয়াদী শিক্ষা দেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন মাধ্যমে নবজাগরণের উন্মেষ ঘটবে বলে সকলে মনে করেন। তৎকালীন সময় বুনিয়াদী শিক্ষা ‘নঈ তালিম‘ নামে পরিচিত হয়। এই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়েই শিক্ষার্থীদের স্বাবলম্বী, স্বনির্ভর এবং তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তিভূমি গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এই নঈতালিম বুনিয়াদী শিক্ষা পরিকল্পনা গান্ধীজি চারটি স্তরে শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেছেন। প্রতিটি স্তরে কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই স্তরগুলি হল –

  • 🅐 প্রাক বুনিয়াদী স্তর – এই স্তরে ৭বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া হয়।
  • 🅑 বুনিয়াদী স্তর – এই স্তরে ৭-১৪ বছরের শিক্ষার্থী শিক্ষা দেওয়া হয়।
  • 🅒 উত্তর বুনিয়াদী স্তর – এই স্তরে ১৪ বছরের বেশি বয়স্ক শিক্ষার্থীদের এই স্তরে শিক্ষাদানের কথা বলা হয়েছে।
  • 🅓 প্রাপ্ত বয়স্কদের শিক্ষাস্তর – এই স্তরে প্রাপ্ত বয়স্কদের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

বুনিয়াদী শিক্ষার বৈশিষ্ট্য

সত্য, অহিংসা ও প্রেমের আদর্শে বিশ্বাসী গান্ধীজি তার বুনিয়াদী শিক্ষাব্যবস্থায় মধ্যে দিয়ে সাম্যবাদী যে রামরাজত্ব গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেখানে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি তুলে ধরা যেতে পারে।

০১. চরিত্র গঠন

গান্ধীজি প্রবর্তীত শিক্ষার দ্বারাই আদর্শ চরিত্র গঠনকে বুনিয়াদী শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

০২. শিক্ষার লক্ষ্য

বুনিয়াদী শিক্ষার লক্ষ হল সক্রিয়তাভিত্তিক শিক্ষা। এই শিক্ষা পদ্ধতিতে গতানুগতিক পুঁথিগত শিক্ষার পরিবর্তে কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

০৩. শিল্প শিক্ষা

বুনিয়াদী শিক্ষা ব্যবস্থাতে শিক্ষার্থীদের নিজ হস্ত শিল্পের উপর ভিত্তি করে সমগ্র শিক্ষাদান শিক্ষাদান কার্য পরিচালনা করার উপর জোর দেওয়া হয়।

০৪. সাবলম্বী গঠন

এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা আর্থিক দিক দিয়ে কিছুটা সাবলম্বী করার উদ্দেশ্যে শিল্পশিক্ষার মাধ্যমে উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রিয় করে অর্থ উপার্জন করবে।

০৫. শিক্ষাদান পদ্ধতি

এই শিক্ষাপরিকল্পনাতে শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের কথা বলা হয়েছে।

০৬. আদর্শ ব্যক্তিত্ব গঠন

ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজতন্ত্রীক উভয় ধরণের লক্ষের সমন্বয়ের মাধ্যমে আদর্শ ব্যক্তি গঠন করবে।

বুনিয়াদী শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক গুণ থাকলেও এই শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক প্রয়োগগত ত্রুটি থাকার ফলে ভারতবর্ষে এই শিক্ষাব্যবস্থা তেমন ভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি।

বুনিয়াদী শিক্ষার গুণাবলী

ভারতবর্ষের শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন জাতীয় নেতৃবৃন্দের উদ্দ্যেগে জাতীয় ঐতিহ‍্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার যে প্রচেষ্টা শুরু হয়, তার ফলশ্রুতি হিসাবে গান্ধীজির বুনিয়াদী শিক্ষা ব্যবস্থার গুণাবলী প্রকাশের কথা উল্লেখ করা হল। তা নিম্নরূপ –

০১. সক্রিয়তাভিত্তিক শিক্ষা

বুনিয়াদী শিক্ষা হল সক্রিয়তা ভিত্তিক শিক্ষা। এই শিক্ষা পদ্ধতিতে কর্মের মাধ্যমে শিক্ষাদানের মূলনীতি স্বীকৃত হয়েছে এবং গতানুগতিক পুঁথিগত শিক্ষার প্রাধান্যকে খর্ব করা হয়েছে।

০২. শ্রমের প্রতি মর্যাদাবোধ

এই শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শ্রমের প্রতি মর্যাদাবোধের বিকাশ ঘটে।

০৩. সামাজিক সচেতনতার বিকাশে সহায়ক

সামাজিক উপকারিতা বিচার করে শিল্প নির্বাচন করার ফলে এই পদ্ধতিতে সমাজ সচেনতার বিকাশ ঘটে।

০৪. কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষা

এই শিক্ষা পদ্ধতি মূলত কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষা। যা শিক্ষার্থীদের কর্মের দ্বারা হাতে কলমে শিখতে পারবে।

০৫. মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান

বুনিয়াদী শিক্ষা ব্যবস্থায় মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

০৬. ব্যক্তিগত ও সামাজিক গুণাবলীর বিকাশ

এই শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, দায়িত্ববোধ, সহযোগিতা, সাবলম্বী, দলপ্রীতি প্রভৃতির দ্বারা ব্যক্তিগত ও সামাজিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটে।

এছাড়া শিক্ষার্থীকে স্বাধীন ভাবে কাজ করার, শিল্প দ্রব্য উৎপাদন করে শিক্ষার ব্যয় নির্বাহ করা এবং উৎপাদনশীল নাগরিকে পরিণত হওয়ার শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল।

বুনিয়াদী শিক্ষার সীমাবদ্ধতা

০১. সঠিক পরিকল্পনার অভাব

এই শিক্ষা পদ্ধতিতে স্বার্থক ভাবে স্বনির্ভরতার কথা বলা হলেও কার্যক্ষেত্রে সেটির একটি অবাস্তব পরিকল্পনা বলে মনে হয়েছে।

০২. উপযুক্ত পরিবেশের অভাব

গ্রাম্য পরিবেশে এই শিক্ষা পদ্ধতির প্রয়োগ করা কিছুটা সহজসাধ্য হলেও শহরাঞ্চলের ক্ষেতে শিল্প নির্বাচন করা খুবই কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়ে।

০৩. সৃজনশক্তির অভাব

এই শিক্ষা পদ্ধতিতে শিল্পের মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হলেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশক্তির পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে অসমর্থ থাকে।

০৪. সুযোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব

এই শিক্ষা পদ্ধতি সার্থক ভাবে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে সুযোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাব দেখা দেয়।

০৫. পাঠ‍্যবিষয়ের প্রতি অমনযোগী

শ্রমের প্রতি অধিক প্রাধান্য দেওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠ্য বিষয়ের প্রতি অমনযোগী হয়ে পড়ে।

উপরোক্ত সীমাবদ্ধতাগুলো থাকার সত্ত্বেও এই শিক্ষা পদ্ধতিতে যৌথ ও ব্যক্তিগত কর্মের উপর নির্ভর করে শিক্ষা দেওয়া হয় বলে এর দ্বারা শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত ও সামাজিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটে।

আত্মসিদ্ধির মধ্যে দিয়ে মানব হৃদয়ের পরিবর্তন সাধন করতে গান্ধীজি যে বুনিয়াদী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন, তা ভারতবর্ষে সফল না হলেও ইহার গুরুত্ব মোটেও কম নয়।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Recent posts

popular posts