নারী ও স্ত্রী শিক্ষার বিস্তারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান | নারী শিক্ষার প্রসারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান
সুপ্রিয় বন্ধুরা,
আজকের পোস্টে নারী ও স্ত্রী শিক্ষার বিস্তারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করলাম। যেটিতে নারী শিক্ষা বিস্তারে বা প্রসারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা খুব সুন্দরভাবে আলোচনা করা আছে।
নারী ও স্ত্রী শিক্ষার বিস্তারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদানঃ
ঊনবিংশ শতকের মধ্যাংশ সময়ে বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষে যে নবজাগরণের উন্মেষ ঘটেছিল, সেই সময়ে যে সকল মনিষী অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। রাজা রামমোহন রায় তৎকালীন ভারতীয় সমাজে নারীর মর্যাদা, নারী অধিকার ও নারী শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে নবজাগরণের সূচনা ঘটাতে চেয়েছিলেন, পরবর্তীকালে তারই উত্তরসূরী রূপে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরে তা পূর্ণাঙ্গ রূপলাভ করে। নারী ও স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে তার যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন, তা নিম্নে আলোচনা করা হলো –
০১) বাংলার পল্লী অঞ্চলে নারীশিক্ষার বিস্তারঃ
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শুধুমাত্র বাংলা তথা ভারতবর্ষের প্রাণকেন্দ্র কলকাতার মধ্যবিত্ত সমাজে নারী শিক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করেননি বাংলার পল্লী অঞ্চলের নারী শিক্ষার ক্ষেত্র প্রস্তুত ও বিস্তার করেছিলেন। তিনি নিজে ১৮৫৭ খ্রীস্টাব্দে বর্ধমান জেলার জৌগ্রামে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে।
০২) বেথুন বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাঃ
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটি স্মরণীয় কাজ হল বালিকাদের জন্য বেথুন বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। তৎকালীন শিক্ষা কাউন্সিলের সভাপতি মি: ডি ডব্লিউ বেথুনের সাহায্য নিয়ে ১৮৪৯ সালে মেয়েদের একটি অবৈতনিক – ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। যার নাম দেন ‘কলিকাতা বালিকা বিদ্যালয়’ পরবর্তী কালে বেথুন সাহেবের নামানুসারে এই বিদ্যালয়ের নামকরণ করেন ‘বেথুন বালিকা বিদ্যালয়’। এই স্কুলে ছাত্রীদের বিনা বেতনে পাঠ্যপুস্তক হিসাবে বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হত। এছাড়াও হাতের লেখা ও সূচীকর্মের শিক্ষাও দেওয়া হত। বাংলা তথা মাতৃভাষা শিক্ষা সকলের জন্য আবশ্যিক ছিল, তবে ইংরাজি শিক্ষাকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবেও শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল।
১৮৫০ সালে বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজে স্কুলটির সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। ওই সময় তাঁর অনুরোধে অভিজাত ব্যক্তি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ কন্যা সহ তারানাথ বাচস্পতি ও শম্ভুনাথ পন্ডিতের কন্যাগণ ভর্তি হন।
০৩) স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে হ্যালিডে সাহেবের সান্নিধ্য লাভঃ
১৮৫৭ সালের প্রথমাংশে বাংলার প্রথম ছোটলাট হয়ে হ্যালিডে সাহেব আসেন। তিনি বাংলাদেশে স্ত্রীশিক্ষার বিস্তারের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহযোগিতা লাভ করেন। হ্যালিডে সাহেবের সাথে একমত হয়ে বিদ্যাসাগর স্থির করেন, যে গ্রামের অধিবাসীরা বিদ্যালয়ের জন্য স্থান দিতে পারবে সে গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়।
এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮৫৮ সালে মেদিনীপুর জেলায় ৩টি, বর্ধমান জেলায় ১১টি, হুগলী জেলায় ২০টি, নদীয়া জেলায় ১টি সহ মোট ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
০৪) নারী শিক্ষা ভান্ডার গঠনঃ
বিদ্যাসাগর আশা করেছিলেন যে এই বিদ্যালয় গুলি আর্থিক সাহায্য পাবে। কিন্তু বছর ঘুরতো না ঘুরতে তিনি বুঝতে পারলেন যে, ভারত সরকার আর্থিক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসতে অনিচ্ছুক। বিদ্যাসাগর মহাশয় তখন বিদ্যালয় গুলির আর্থিক সমস্যা সমাধানের জন্য ‘নারী শিক্ষা ভান্ডার’ নামে একটি অর্থ ভান্ডার গঠন করবে।
০৫) গণশিক্ষার প্রসারঃ
সমাজের সকল স্তরের নারী ও স্ত্রীদের সত্যিকারের গণশিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি গনচেতনার বিকাশ না ঘটানো গেলো বহু বিবাহের মত কুৎসিত প্রথার বিলোপ সাধন করা সম্ভব হবে না।
০৬) নারীমুক্তি বিধবা বিবাহের সামাজিক প্রসারের শিক্ষাঃ
বিধবা বিবাহ প্রস্তাব বের হওয়ার পর থেকে বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে কট্টর পন্থীরা ঘোর আন্দোলন আরম্ভ করে। এই বহুবিবাহ প্রথার বিলোপ এবং বিধবাবিবাহ প্রচলনের উদ্দেশে বিদ্যাসাগর কয়েকটি ব্যঙ্গরসাত্মক পুস্তিকা রচনা করেন। সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘বিধবা বিবাহ বিষয়ক প্রস্তাব’, ‘রত্ন পরীক্ষা’, ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’। যা নারী সমাজকে উজ্জিবিত করে।
পরিশেষে বলা যায় যে নারী ও স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন করা অসম্ভব। নারীমুক্তি ও নারীশিক্ষার প্রসারে বিস্তারে তার অক্লান্ত প্রচেষ্টা যে শুধু ভারতীয়দের শিক্ষাপ্রসারে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা নয়, তদানীন্তন শিক্ষা শিক্ষানীতিকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছিল। এজন্য বিদ্যাসাগরের নাম ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
■ Also Check : সমাজ সংস্কারক হিসাবে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান